উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার চতুর্থ দিনে প্রতিবাদে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, লেখক, নাগরিক ও বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, মৌন অবস্থান ও কফিন মিছিল করে। মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের ওপর বারবার আঘাত সত্ত্বেও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে চারটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন।
অন্যদিকে দীপন হত্যা ও প্রকাশক-লেখকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে গতকাল সারা দেশে আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে। হরতাল শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে কফিন মিছিল এবং পরের দিন শুক্রবার বিকেলে শাহবাগে সংহতি সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
নিহত ফয়সল আরেফিন দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে। গত শনিবার শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রায় একই সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল ও দুই লেখককে গুরুতর জখম করা হয়।
প্রকাশক ও লেখকদের ওপর এই জোড়া হামলার প্রতিবাদে গতকাল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে আমরা মর্মাহত, ব্যথিত। সহকর্মীকে সমবেদনা কিভাবে জানাব তার ভাষা আমাদের নাই। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালীন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে আমরা বসে থাকতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবারই বলে আসছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কোনো সম্পর্ক নেই। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আমরা বলতে চাই, মুক্তমনা লেখকদের নিরাপত্তা ও খুনিদের বিচারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার দায় স্বীকার ও প্রগতিশীল লেখক-শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে পড়ুন। মুক্তমনাদের রক্ষা করতে আমরাই ছাত্র-শিক্ষক প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখকদের ওপর হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনুন। প্রতিটি হামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের ধরে ফেলব।’ কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়ে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি দায়িত্বকে সালাম জানিয়ে পদত্যাগ করুন। আমরা দক্ষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাই, যিনি জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারবেন। আপনি ব্যর্থ হয়েছেন।”
বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমা শাহীন, সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবদুল আজিজ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শফিক-উজ-জামান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক গোলাম রব্বানীসহ দুই শতাধিক শিক্ষক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ : খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে চারটি বাম ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এর আগে সকাল ১১টায় দীপন হত্যাসহ সব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে সংগঠনগুলো। মিছিলটি টিএসসি, জাতীয় জাদুঘর হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাবেশে মিলিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সৈকত মল্লিক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর আহ্বায়ক ফয়সাল ফারুক অভিক, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আল ইমরান প্রমুখ।
‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-লেখক ও নাগরকিবৃন্দ’ ব্যানারে সমাবেশ : দীপনের খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-লেখক ও নাগরিকবৃন্দ’ ব্যানারে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে খুনিদের গ্রেপ্তার করতে আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, বাংলা বিভাগের শিক্ষক রফিকুল্লাহ খান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতিয়ারা নাসরিন ও ফাহমিদুল হক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা, মেহের নিগার প্রমুখ।
ছাত্র জাগরণের কফিন মিছিল : বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জাগরণ’ ব্যানারে মৌন অবস্থান ও কফিন মিছিল করা হয়েছে। দুপুর ১টায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে মৌন অবস্থান শেষে কফিন মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়।
গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে হারতাল : দীপনের খুনি ও প্রকাশক-লেখকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে সারা দেশে আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে। কয়েকটি সামাজিক-রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন হরতালের প্রতি সমর্থন দিয়ে অবস্থান নেয় রাজপথে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় অবরোধ করে অবস্থান নেয় মঞ্চের কর্মীরা। ওই সময় তারা রাস্তায় বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও পরিবেশন করে। হরতালের কারণে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি।
হরতাল সফল হয়েছে দাবি করে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে কফিন মিছিল এবং শুক্রবার বিকেলে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে সংহতি সমাবেশ। হরতালের কারণে জেএসসি পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটায় দুঃখ প্রকাশ করেন ডা. ইমরান।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ হরতাল : দীপন হত্যা ও প্রকাশক-লেখকদের ওপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে গতকাল রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন স্থানে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে।
আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, নগরে হরতালের সমর্থনে মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। জামালখান এলাকায় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ইটপাটকেল ছুড়েছে হরতালকারীরা। মীর কাসেম আলী মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
সিলেট অফিস জানায়, নগরে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। তবে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এদিকে দুপুরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
খুলনা অফিস জানায়, নগরীতে ঢিলেঢালা হরতাল পালিত হয়েছে। নগরীর পিকচার প্যালেস মোড় ও আশপাশ এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে সকাল ১১টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হাদী চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।
রংপুর অফিস জানায়, হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে নগরে। হরতালে কিছু দোকানপাট বন্ধ ছিল। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল না করলেও নগরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
Post a Comment