
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের তেলিপাড়া থেকে ঢাকার সাতরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার সড়কে ২২টি ইউ লুপ স্থাপন করে সড়কে যান চলাচল নিরবচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই সড়কে যানজটের বড় কারণ স্থানে স্থানে থাকা ৬৯টি ক্রসিং। এসব ক্রসিং বন্ধ করে যান চলাচলের অংশে এমন অবকাঠামো তৈরি করা হবে যাতে বৃত্তাকার পথে গাড়িগুলো ইউ টার্ন করতে পারে। আগামী জুন মাসের মধ্যে এ ব্যবস্থা চালু হবে বলে আশা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য অর্ধযুগ ধরে গবেষণারত প্রকৌশলী কামরুল হাসানের ইউ লুপ স্থাপনের প্রস্তাব উপস্থাপনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ আগ্রহে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত চেষ্টায় এটি বাস্তবে রূপ দেওয়ায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন মেয়র আনিসুল হক। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই সড়কে ইউ লুপ বাস্তবায়নের জন্য এর প্রশস্ততাও বাড়াতে হবে। ২২টি ইউ লুপ স্থাপনে প্রায় ৩৭ বিঘা জমির দরকার হবে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অধীনে এসব জমি রয়েছে। সরকারি সংস্থার অধীনে থাকায় এসব জমি আর অধিগ্রহণ করতে হবে না, আর এ কারণে সময়ক্ষেপণও হবে না। জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার মধ্যে অবস্থিত বনানী অংশে সেতু ভবনের কিছু জায়গাও এ জন্য ছেড়ে দিতে হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল এ ব্যাপারে বলেছেন, জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। গাজীপুর থেকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা অংশে দুই ধরনের ইউ লুপ বসানো হবে। তার মধ্যে একটি হবে বাস ও ছোট গাড়ি ঘোরানোর জন্য। অন্যটি হবে শুধু ছোট গাড়ি ঘোরানোর জন্য। একটি থেকে আরো একটি ইউ লুপের সর্বনিম্ন দূরত্ব হবে ৮০০ মিটার। সর্বোচ্চ দূরত্ব হবে প্রায় তিন কিলোমিটার। ডাবল ইউ লুপ বসানো হবে তেলিপাড়া, ওটপাড়া, পিপলস সিরামিকস, আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়াল সড়ক অংশে। এ ছাড়া ইউ লুপ বসানো হবে ইস্টার্ন বাইপাস, মিল্লাত মাদ্রাসা, আব্দুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং, উত্তরার রাজলক্ষী মার্কেট, র্যাব কার্যালয়, কাওলার ফ্লাইং একাডেমি, আর্মি গলফ ক্লাবের সামনে, বনানী উড়াল সড়কের নিচে, চেয়ারম্যান বাড়ি অংশে, মহাখালী উড়াল সড়কের নিচে, কোহিনূর কেমিক্যাল, সিরামিকস ইনস্টিটিউটের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত হোটেল মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য বড় বড় উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আরো কিছু নির্মাণের উদ্যোগ আছে। কিন্তু একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এসব উড়াল সড়কে যানজট স্থানান্তরিত হচ্ছে, কমছে না। সাময়িকভাবে কোনো এলাকার লোকজন সুখ ভোগ করলেও ভবিষ্যতে এসব উড়াল সড়ক ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দেখা দিতে পারে। বছরের পর বছর ধরে উড়াল সড়ক নির্মাণের বিলাসী প্রকল্প বাদ দিয়ে বিদ্যমান সড়কে ইউ লুপসহ ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের প্রস্তাব করে আসছিলেন এসব প্রকৌশলী। কিন্তু ‘কমিশন বাণিজ্যের’ প্রভাবে ইউ লুপ তত্ত্ব কেউ গ্রহণ করেনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগমের কাছে প্রকৌশলী কামরুলের প্রস্তাব গেলে তিনি মূলত প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। এ ব্যাপারে নতুন এ কৌশলের উদ্ভাবক প্রকৌশলী কামরুল হাসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিগন্যালে সিগন্যালে আটকে থেকে সময় নষ্ট হচ্ছে। যানজটে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। তাই বলে আসছিলাম ইউ লুপ পদ্ধতি স্থাপন করে যানজট নিরসন করা যায়। আমার এই পদ্ধতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জেনে আমি খুশি। তবে সেটি যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়।’ গতকালের অনুষ্ঠানে মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘তিন মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে প্রকৌশলী কামরুলও ছিলেন। আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর আমরা রাস্তায় নামি। আমি এ জন্য রাস্তায় গেছি ১০-১১ বার। প্রকৌশলীরা ২০-২৫ বার গেছেন রাস্তায়। প্রথমে আমরা বলেছিলাম, কাকলী থেকে জসীমউদ্দীন অংশে এটি করার জন্য। পরে প্রকল্পের পরিধি বাড়ানো হয়।’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘আজকের এই অনুষ্ঠানটি খুব আনন্দের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি বিশেষ ইউনিট মানুষের কাছে সহজে কিভাবে সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে গবেষণা করে থাকে। আমি কামরুলের এই প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে বুয়েটের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলি, পরে অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছি।’ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ তানভীর নেওয়াজ বলেন, যানজটের কারণে বছরে ২১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সড়কের এ অংশে যানজট ৩০ শতাংশ কমে যাবে। গাজীপুর থেকে সাতরাস্তা অংশে ২০টি ইন্টারসেকশন আছে। ডান দিকে মোড় নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ এস এম সালেহউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি করা হলে যানজট ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাবে। এই অংশ দিয়ে বিআরটি, এমআরটি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হবে। এসব প্রকল্পের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক হবে না। বিদেশিদের সহায়তায় নয়, নিজেদের চেষ্টায় আমরা এটি বাস্তবায়ন করতে পারব।’
Post a Comment